কিতাবনামা

ভ্রমণ কাহিনীর প্রতি সবসময়ই একটা আলাদা টান অনুভব করি। সেই ভ্রমণ যেই দেশেতেই হোক, যেই লেখকেরই হোক। এ যেনো বাসার ঘরেতে আটকে থেকেই বাইরে ঘুরে আসা। মক্কা-মদিনার সফর পড়ে তাই পড়তে মন চায় ইউরোপ মুল্লুকের ভ্রমনটাও। তুর্কি আফগানের ভ্রমণের পর তাই জানতে ইচ্ছে হয় ভারত-নেপালের যাত্রাটাও।

সবসময় চাইতাম বাংলাবাজারে এমন একটা দোকান থাকবে যেখানে নানান প্রকাশনীর বই একসাথে পাওয়া যাবে। দোকান থেকে দোকান আর গলি থেকে গলি চক্কর লাগাতে হবে না। তারুণ্য প্রকাশনের বিক্রয়কেন্দ্র হওয়ার পর সেই আশাটা পূরণ হয়ে গেছে। কী সুন্দর গোছানো একটা দোকান। ইদানীং বেশি বই কেনা হয় এখান থেকেই।

একটা সময় ছিলো যখন ঘুমানোর আগে একটু আধটু বইটই অবশ্যই পড়া হতো। তবে পরিস্থিতি এখন একদমই অন্য। বই নিয়ে বিছানায় যাওয়া হয় ঠিক। কিন্তু বই থাকে বইয়ের জায়গায়। চোখে এসে জায়গা নেয় সাধের ঘুম। চোখ খোলা রাখার যতোই কসরত করা হোক, ঘুম তার দুহাত দিয়ে বইটাকে পাঠিয়ে দেয় একদম কিনারায়।

দুই ধরণের বই জীবনের ওপর তীব্রভাবে প্রভাব ফেলে। এক, যে বইয়ের বিষয়বস্তু আমার বর্তমান জীবন পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত। দুই, যে বইয়ের বিষয়ের প্রতি আমার আছে প্রবল আগ্রহ। এই দু'ধরণের বই পড়ার সময় আলাদা মনোযোগ বা নোটের দরকার পড়ে না। নিজ থেকেই বইয়ের কথাগুলো হৃদয়ে গেঁথে যেতে থাকে।

একুশে বইমেলা চলাকালে অনেকেই বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপে। পোস্টারে ভরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এভাবে টাকা না ঢেলে তাদের উচিত ছিলো সেই টাকা দিয়ে নিজের বইয়ের কিছু কপি কেনা। নিজ বন্ধুস্বজনদের সেগুলো পড়তে দেয়া। কয়েকটা বই তাও হয়তো মানুষের হাতে পৌঁছাতো। লোকজন একটু উলটে পালটে দেখতো।

শক্তি ভাইয়ের 'অবাধ্যতার ইতিহাস' শুরু করার পর হজম করতে কষ্ট হচ্ছিলো। বিভিন্ন সোর্স থেকে নানান তথ্যের মিশেল মাথাতে খুব ভারী মনে হচ্ছিলো। পড়াও চলছিলো ধীর গতিতে। তবে একশো পাতার দিকে এসে বইটার পরিবেশই পালটে গেছে। এখান থেকেই শক্তি ভাইয়ের দারুণ উপস্থাপনার গুণে বইটা হয়ে উঠেছে অনন্য।

যখন থাকবো না আর এই দুনিয়ায়। মনে পড়বে তখন ভীষণভাবে এই বাংলাবাজারের কথা। সুযোগ পেলেই সেইখানে ছুটে যাওয়া। এ দোকান থেকে সে দোকান। এই গলি থেকে ঐ গলি। বইয়ের মাঝেই সব ঝোঁক ও মনোযোগ। ইসলামি টাওয়ার, মাদরাসা মার্কেট, কম্পিউটার কমপ্লেক্স। গিয়াস ভবন, নর্থ ব্রুক হল আর প্যারিদাস রোড।

'অবাধ্যতার ইতিহাস' বইয়ের একটা অংশ 'স্পর্ধানামা'। শুধু অংশ না, বরং বইয়ের সবচেয়ে সেরা অংশ। শুধু এই অধ্যায়টা নিয়েই ওয়াল্লাহি একটা আলাদা বই করা প্রয়োজন। শক্তি ভাইয়ের কুররাতু আইয়ুন শেষের পর কেউ যদি এই স্পর্ধানামা হৃদয়ঙ্গম করে নেয়, সে পরিবর্তনে বাধ্য। ভেঙে টুকরো হতে বাধ্য।

একটা রাস্তা প্রথমবারে অপরিচিত লাগলেও, দ্বিতীয়বার সেখানে গেলে অনেকটাই চেনাচেনা লাগে। কোন বিষয়ে একটা বই পড়ার পর অনেক জায়গায়ই ঘোলাটে থেকে যায়। সাথে সাথেই যদি একই বিষয়ের আরেকটা বই পড়া যায়, অনেক কিছুরই তখন খোলাসা হয়ে যায়। 'অবাধ্যতার ইতিহাস' শেষে তাই পড়ছি 'হিউম্যান বিয়িং'।

একে একে নবীজির (স) হাদিসগুলো পড়ে যাওয়া। এক অবর্ণনীয় প্রশান্তি। পুরোদস্তুর হাদিসের কিতাব। নেই লেখকের নিজস্ব কোন কথা। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চাপ। সেখানে শুধুই আল্লাহর রসূলের কথা। শুধু তাঁরই উচ্চারণ। শব্দ আর বাক্য। এ যেনো ঘরে বসেই তাঁর মজলিসে উপস্থিত। সুকুন সুকুনে ভরা প্রতিটা ক্ষণ।

বেশি কিছুদিন থেকেই বইপড়ায় কোন মনোযোগ ছিলো না। একবার এই বই পড়ি তো একবার ঐ বই। চার পাঁচটা বই ঘুরেফিরে এসে থিতু হলাম ইমরান রাইহান ভাইয়ের '১৮৫৭- স্বাধীনতা যুদ্ধের উপাখ্যান'-এ। অন্য বইতে যেখানে ৩০-৪০ পাতা পড়ার পরই মনটা হটকে যাচ্ছিলো। এই বইয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় ১০০ পাতা পর্যন্ত।

মৌসুমি ফলগুলো নিজ মৌসুমেই থাকে আসল স্বাদে। অন্য সময় তা পাওয়া গেলেও, স্বাদ হয় না আসলটার মতোন। ইবাদত বিষয়ক বই পড়ার ব্যাপারটাও তেমন। রোজা সময় রোজার‍, হজের সময় হজের আর কুরবানির সময় কুরবানি বিষয়ক বই। সময়মতোন পড়ে নেয়া গেলে সেই বইয়ের স্বাদ হয় অন্য সময় থেকে অনেক গুণ বেশি।

মাকতাবাতুল ফুরকানের 'আত্মার পাথেয়' পড়ছিলাম। মুফতী শামসুদ্দীন জিয়া সাহেবের মালফুজাত সংকলন। অর্ধেকের মতো পড়াও হয়েছে। কিছু জায়গায় হুজুরের কথাগুলো মনে দাগ কেটেছে। তবে বইয়ের ভাষা আরো গোছানো হওয়া উচিত ছিলো। অনেক জায়গায় বাক্যগুলো কেমন যেনো খাপছাড়া। সাথে বানানেও অনেক সমস্যা।

যাত্রাবাড়ী কিতাব মার্কেট। মোল্লারবই.কম-এ বইটই দেখছি। এই সময় এক লোক এসে দোকানে বললো, একটা ১৭৫৭ দেন। দোকানের লোকও সুন্দর করে ইমরান ভাইয়ের ১৮৫৭ বইটা বের করে দিলো। সিএনজিওয়ালাকে সবসময় মিটার থেকে বাড়িয়ে দিতে দেখেছি। কিন্তু বইও যে ১০০ ইউনিট বাড়িয়ে দেয়া যায়, তা এই প্রথম দেখা!

একবার বাসে এক লোক উঠলো। হাতে ছোট ছোট নানান বই। বইয়ের প্রচারে সে বলতে লাগলো- 'বই কেনার প্রয়োজন নেই। বইটা অন্তত হাতে নিয়ে দেখুন। বই হাতে নিয়ে দেখাও এক ধরণের অভিজ্ঞতা।' আসলেই। শুধু বই হাতে নিয়ে দেখা কেনো। বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাও এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা ফিকশন বইগুলো আমার জন্য না। ইতিহাসের কোন বিষয় জানতে ‘শুষ্ক, রসকষহীন’ নন-ফিকশনই সেরা। সত্য ঘটনা জানার জন্য ফিকশন পড়তে গেলে মনে হয়, এই সময়টা অন্য আরেক বইয়ের পেছনেই দেয়া যেতো। এ বাদে ইতিহাস নির্ভর ফিকশনে মনগড়া কেচ্ছা কাহিনী থেকে দূরে থাকাও কাম্য।

ইতিহাসের বইয়ে যুদ্ধের খুঁটিনাটি বিবরণ থাকলে সেই বই পড়াটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কোন যোদ্ধা কার ওপর তলোয়ার দিয়ে হামলা করলো, কে কার আঙ্গুল কামড়ে ধরলো, কে কার ডান বাহু দিয়ে আরেকজনার বাম চিবুকে আঘাত করলো, এই শুকনো বর্নণাগুলো প্রায়ই ইতিহাস বই পড়ার মজাটাকে অনেকটাই নষ্ট করে দেয়।

ইতিহাসের আলোচিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে ইসমাইল রেহান সাহেব আসলেই অনন্য। পড়ছিলাম মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। ৫ম খণ্ড। আলি ও মুয়াবিয়া রদিয়াল্লহু আনহুমার নানা বিষয় বর্ণনায় রেহান সাহেবের মুন্সিয়ানার পরিচয়। বিশেষ করে হুজর ইবন আদির (র) ঘটনা ও ইয়াজিদের খিলাফাহ নিয়ে তার অসাধারণ বিশ্লেষণ।

প্রত্যেককে ধরে ধরে যদি একটা বই পড়ার কথা বলতাম, সেই বইটা হতো আল কুরআন একাডেমির কুরআনের অনুবাদ। সহজ সরল ভাষায় কুরআনের কথা তুলে ধরায় এই কিতাব অতুলনীয়। কিতাবে আয়াতের অনুবাদগুলো পড়লে মনে হয়, আল্লাহ যেনো এখনই আমাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলছেন। আমার জীবনটাকে বদলে দিয়ে যাচ্ছেন।

বইপড়াটা একজন মানুষকে সময় দেয়ার মতোন। পাঠক যখন একটা বই পড়ে, তখন সে আসলে ঐ লেখককে সময় দেয়। আর যাকে সময় দেয়া হয়, সে তো চাইবেই, আমার পুরো মনোযোগ যেনো শুধু তার দিকেই থাকে। এদিক ওদিক যেনো লাফিয়ে না বেড়ায়। তাই বই পড়ার সময় একবারে একটা বই-ই পড়া উচিত। দু’তিনটা বই একসাথে নয়।

পড়ছিলাম ইফতেখার সিফাত ভাইয়ের ফাহমুস সালাফ। উম্মাহর শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম কিভাবে দীন বুঝতেন আর আমরাই বা কিভাবে দীনকে বুঝবো? এই নিয়েই আলোচনা। বরাবরের মতোই সিফাত ভাইয়ের যৌক্তিক-গোছানো উপস্থাপন। নারীবাদ, বিজ্ঞান, চিন্তার স্বাধীনতার মতো বিষয়ে সালাফদের বুঝের সাথে আমাদের বুঝের বোঝাপড়া।

নিজের পড়ার রুচির সাথে মানানসই লেখকের নাম যদি বলতাম, তারা দুজন হতেন- ইফতেখার সিফাত ভাই ও শামসুল আরেফিন শক্তি ভাই। নিজ পড়ার রুচির সাথে লাগসই দুই প্রকাশনীর নাম যদি বলতাম, তাহলে সেগুলো হতো মাকতাবাতুল আসলাফ ও নাশাত পাবলিকেশন। নামের এই তালিকা আরো বড় করা গেলেও, ওপরে থাকবে এই চারটাই।